ক্যান্সার একটি ঘাতক ব্যাধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৩ সালের সমীক্ষা মতে বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৩ লক্ষ ক্যান্সার রোগী রয়েছে, তারমধ্যে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লক্ষ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং দেড় লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২১% এর বেশি মাতৃমৃত্যুর কারণ ক্যান্সার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষেরও অধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। দিন দিন এর পরিমাণ আরো বাড়ছে। এদের বেশির ভাগ ফুসফুস, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুহার ১২.৭% এ দাঁড়াবে। শতকরা ৪০ ভাগ ক্যান্সার অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। তাই আসুন আজ জেনে নেই এই ঘাতক ব্যাধি সম্পর্কে কিছু কথা। ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো কী এবং কোন ক্যান্সার কাদের বেশি হয়, সেটাই আজ আমরা জানবো।
ক্যান্সার আসলে কী?
সাধারন শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় দেহের কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়ম মতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। সাধারনভাবে বলতে গেলে যখন এই কোষগুলো কোনো কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়, একেই টিউমার বলে। এই প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা শাস্ত্রে নিওপ্লাসিয়া (NEOPLASIA) বলে, এবং এই অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিকে বলে নিওপ্লাজম (NEOPLASM)।
এই টিউমার কখনও কখনও বিনাইন হতে পারে, আবার কখনও হতে পারে ম্যালিগ্ন্যান্ট। বিনাইন হচ্ছে নিরীহ টিউমার। এতে শরীরের ক্ষতি সাধন হয় না সাধারণত। কিন্তু কোন টিউমার ম্যালিগ্ন্যান্ট হওয়া মানেই তা ক্যান্সার এবং যা হতে পারে প্রাণঘাতী। সাধারণত বিনাইন টিউমারে শরীরের ক্ষতি না হলেও অনেক সময় বিনাইন টিউমারও ম্যালিগ্ন্যান্ট এ রূপ নিতে পারে। তাই শরীরের কোথাও কোনো চাকা বা দলা অনুভব করলে তা বিনাইন না ম্যালিগ্ন্যান্ট, সেটা যাচাই করে নেয়া জরুরী।
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো কী?
- খুসখুসে কাশি বা গলার ভাঙ্গা স্বর
- অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ
- সহজে ভালো হচ্ছে না এমন ক্ষত
- কাশির সাথে রক্ত আসা
- স্তনে বা শরীরের অন্য কোথাও চাকা বা পিন্ডের মতো অনুভব করা
- খাবার গিলতে অসুবিধা
- খাবার হজম না হওয়া
- শরীরের ওজন মাত্রাতিরিক্তভাবে এবং দ্রুত হারে কমতে থাকা
- মল-মূত্র ত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন
- শরীরের কোথাও তিল বা আঁচিল ওঠা বা এ জাতীয় লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দেওয়া
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো জানা হয়ে গেলো। কোন ক্যান্সার কাদের বেশি হয় সেটা এখন জেনে নিন তাহলে।
১) যাদের ফুসফুসের ক্যান্সার বেশি হয়ঃ
- যারা ধূমপান করেন বা ধূমপানকারীদের সাথে বসবাস করেন
- যারা বিষাক্ত কেমিক্যাল এর কারখানায় কাজ করেন
- যারা জর্দা, তামাক, গুল ইত্যাদি ব্যবহার করেন
২) যাদের স্তন ক্যান্সার বেশি হয়ঃ
- ওজন বেশি হলে
- তেল ও চর্বি যুক্ত খাবার বেশি খেলে
- বেশি বয়সে গর্ভধারণ করলে
- যাদের কখনও সন্তান হয়নি
- সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে
- পরিবারে মা, বোন বা রক্তের সম্পর্কের কারো স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে
৩) যাদের জরায়ুর ক্যান্সার বেশি হয়ঃ
- কম বয়সে বিয়ে হলে বা বাল্যবিবাহ
- অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিলে
- ধুমপান করলে
- যৌনাঙ্গে আঁচিল হলে
- নিজের অথবা হাসব্যান্ডের একাধিক যৌন সঙ্গী থাকলে
- এইচ আই ভি সংক্রমিত হলে
৪) যাদের ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার বেশি হয়ঃ
- যাদের কখনও সন্তান হয়নি
- যাদের ৩০ বছর বয়সের পর প্রথম সন্তান হয়েছে
- যেসব নারীর ৫০ বছর বয়সের পর মাসিক বন্ধ হয়েছে
- বংশের কারো ডিম্বাশয়, স্তন, বৃহদান্ত বা গর্ভাশয়ের ক্যান্সার হয়ে থাকলে
ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
১) চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করে অধিক পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খান। তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য সম্পূর্নভাবে বর্জন করুন।
২) দৈনন্দিন ব্যবহারে প্লাস্টিকের পণ্য বর্জন করুন। ফুড গ্রেড প্লাস্টিক ম্যাটেরিয়াল কিনা সেটা দেখে নিন।
৩) নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৪) পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন। পবিত্রতা ও প্রফুল্লতা বজায় রাখুন। হেলদি লাইফস্টাইল মেনটেইন করুন।
বাড়তি কিছু সাবধানতা নারীদের জন্য
১) প্রতিমাসে মাসিক হওয়ার পরের দিন নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা।
২) স্তনে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
৩) মাসিকের কোনো সমস্যা হলে বা অস্বাভাবিক মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
৪) বছরে একবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করা।
৫) প্রতি তিন বছরে একবার প্যাপ স্মিয়ার বা জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষা করা এবং সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে সাথে সাথে চিকিৎসা করা।
শেষকথা
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো কী সেটা তো আমরা জেনে নিলাম। এ রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। অস্ত্রপোচার, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোনাল থেরাপি ইত্যাদি দ্বারা ক্যান্সারের চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণভাবে নিরাময় করা কঠিন। ক্যান্সারে শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও প্রয়োজন।
ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী নিজে এবং পরিবারের লোকজন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। ক্যান্সার নিরাময় করা এককভাবে কোনো ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে সকলকেই। ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা মাত্রই পদক্ষেপ নিন যাতে ক্যান্সার হলেও আর্লি স্টেজে যেন এটা ধরা পড়ে। এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করবেন না। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকবেন।